ঢাকঢোল পিটিয়ে বেশ ঘটা করে দুই বছর আগে দেশে পরীক্ষামূলকভাবে পঞ্চম প্রজন্মের ফাইভজি সেবা চালু করা হয়। গত বছরই বাণিজ্যিকভাবে দ্রুতগতির এই ইন্টারনেট সেবা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার কথা ছিল। সেজন্য ওই বছরের মার্চে মোবাইল অপারেটরদের কাছে তরঙ্গ বিক্রি করে সরকার। এরপর আর কোনো অগ্রগতি নেই। সবাই এখন বলছে, দেশে ফাইভজি সেবার পরিবেশ ও চাহিদা নেই।
এর আগে ২০১৮ সালে দেশে চতুর্থ প্রজন্মের ফোরজি সেবা চালু হয়। গত অক্টোবর পর্যন্ত ১৮ কোটি ৯৬ লাখ মোবাইল গ্রাহকের মধ্যে ১০ কোটি ৫ হাজার গ্রাহক ফোরজি সেবার আওতায় এসেছেন। প্রায় অর্ধেক গ্রাহক এখনো এ সেবার বাইরে। আবার যারা এ সেবার আওতায় রয়েছেন, তাদের অভিযোগ কাঙ্ক্ষিত গতি পাওয়া যায় না।
ফোরজি সেবা পুরোপুরি নিশ্চিত না করেই দেড় বছর আগে অপারেটরদের কাছে ফাইভজি তরঙ্গ বিক্রি করা হলেও এখনো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ এবং নীতিমালা অনুমোদন হয়নি। কবে নাগাদ এ সেবা চালু হবে সেই নিশ্চয়তা দিতে পারেননি কেউ।
সঠিক পরিকল্পনা ছাড়াই এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ায় ফাইভজি চালু করা নিয়ে এখন এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই। তারা বলছেন, এগুলো এক ধরনের রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি। বর্তমান সরকার যে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের কথা বলছে, সেজন্য ফাইভজির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের ৬০টির বেশি দেশে এ সেবা রয়েছে।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সদ্য সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, “ফাইভজি ‘লঞ্চ’ করার যে বিষয়টা ছিল সেটা আমরা ২০২১ সালে করেছি। কিন্তু আমাদের মোবাইল এবং ইন্টারনেটের যে বাজার সে অনুপাতে ফাইভজির চাহিদা এখনো তৈরি হয়নি। কারণ ব্যবহারকারীকে সিম, হ্যান্ডসেট বদলাতে হবে। এটার জন্য মানুষ প্রস্তুত না হলে ফাইভজি চালু করে কোনো লাভ নেই।
‘আমরা প্রধানত ইন্ডাস্ট্রিয়াল (শিল্প) এলাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করে বিটিসিএলের মাধ্যমে যেসব স্পেশাল ইকোনমিক জোন হচ্ছে সেখানে ফাইভজি চালু করার প্রকল্প হাতে নিয়েছি। দেশ জুড়ে এ সেবা বাণিজ্যিকভাবে চালু করার ক্ষেত্রে ব্যবসার সুযোগ তৈরি না হলে মোবাইল অপারেটরা বিনিয়োগ করবে না’ যোগ করেন তিনি।
সমীক্ষা ছাড়াই কেন ফাইভজি পরীক্ষামূলক চালু হলো? চাহিদা তৈরি না হলে পরীক্ষামূলক চালুর ছয় মাস পর কেন তরঙ্গ বিক্রি করা হলো? এসব প্রশ্ন থেকেই যায়।
এ প্রসঙ্গে মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘তরঙ্গ বরাদ্দ ও অন্যান্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা ফাইভজির দরজা উন্মুক্ত করে দিয়েছি। যাতে অপারেটররা ইচ্ছে করলেই সেবা দিতে পারে। আমার পর্যবেক্ষণ হলো তারা কাস্টমারের চাহিদা তৈরির অপেক্ষা করছে। আশা করছি ২০২৪ থেকে ২০২৯ এ সময়ের মধ্যে হয়তো ফাইভজির ব্যবহারটা বাড়বে।’
তিনি বলেন, ‘আমি যখন ফাইভজির বিস্তারে চেষ্টা করছিলাম, তখন প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিলেন ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকাগুলো আগে ফাইভজির আওতায় আনেন। তারপর সাধারণ মানুষের চাহিদা অনুসারে করেন। ফাইভজির দিকে যাওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের যে প্রবণতা সেটা দেখছি না। সাধারণ মানুষের যে চাহিদা সেটা কিন্তু এখনো ফোরজি অতিক্রম করে যায়নি।’
মোস্তাফা জব্বার মনে করেন, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যেমন রোবোটিকস, এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স) কিংবা ব্লক চেইন, আইওটি এ ধরনের টেকনোলজি যদি প্রচলিত হয় এবং সাধারণ মানুষের ব্যবহার বাড়লে ফাইভজির চাহিদা বাড়বে।
ফাইভজি সেবার নীতিমালার খসড়া তৈরির জন্য ২০১৯ সালের আগস্টে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ২০২০ সালে তাদের তৈরি খসড়া বিটিআরসির কমিশন সভায় উত্থাপন করে। ওই বছরই এটি চূড়ান্ত হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। কমিশন থেকে মন্ত্রণালয় হয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে যাচাই-বাছাই শেষে ২০২২ সালেই খসড়াটি প্রায় চূড়ান্ত হয়। কিন্তু এখনো এর অনুমোদন মেলেনি। এটি এখন ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
নীতিমালা বা গাইডলাইনের অভাবে বাজার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না দাবি করে অপারেটররা বলছে, ফাইভজি চালু না হওয়ার পেছনে এটিও একটি কারণ।
এ বিষয়ে মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘নীতিমালার তো দরকার নেই। ফাইভজির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তরঙ্গ বরাদ্দ করা হয়েছে। সরকারের দিক থেকে কোথাও ফাইভজি আটকে রাখা হয়নি। অপারেটররা যদি এ সেবা চালু না করে তাহলে তো সরকারের কিছু করার নেই।’
বাংলাদেশ চীন কিংবা ভিয়েতনাম নয় উল্লেখ করে সাবেক মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে যে কর্মকা- হবে সেটা বাজারের ওপর নির্ভর করে। আগে তো ‘কনজ্যুমার ডিমান্ড’ তৈরি করতে হবে। আমরা দরজা খুলে দিয়েছি। এখন আপনি ঘরে ঢুকবেন কি ঢুকবেন না সেটা আপনার ইচ্ছা।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সূত্রমতে, ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর টেলিটকের মাধ্যমে দেশের ছয়টি স্থানে পরীক্ষামূলক ফাইভজি সেবা চালু করার পর ২০২২ সালের মার্চে নিলামে চার মোবাইল অপারেটরের কাছে ফাইভজি তরঙ্গ বিক্রি করে সরকার। নিলামে ২ দশমিক ৬ গিগাহার্টজ ব্যান্ডের ৬০ মেগাহার্টজ করে ১২০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ কেনে গ্রামীণফোন ও রবি। বাংলালিংক ২ দশমিক ৩ গিগাহার্টজ ব্যান্ডের ৪০ মেগাহার্টজ এবং রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল ফোন অপারেটর টেলিটক একই ব্যান্ডের ৩০ মেগাহার্টজ তরঙ্গ কেনে। এতে সরকারের আয় হয় ১০ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা। ১৫ বছর মেয়াদি ফাইভজি লাইসেন্সের বার্ষিক ফি ১০ কোটি টাকা। এর সঙ্গে নির্ধারিত তরঙ্গ ফি ও আয়ের ৫ দশমিক ৫ শতাংশ বিটিআরসিকে দিতে হবে। সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলে দিতে হবে আয়ের ১ শতাংশ।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, ‘দেশে মোবাইল সেবার অবস্থা যে খুব ভালো সেটা বলা যায় না। ভয়েজ ও ডেটা সার্ভিস এবং নানা দিক বিবেচনায় আমরা অনেক পিছিয়ে। এ অবস্থায় ফাইভজির গালভরা যে ব্যবহারের কথা বলা হয় সেটা দেশে এখনো নেই। এই মুহূর্তে ফাইভজি খুবই জরুরি না। এখনো নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা পাওয়া যায় না। মানসম্মত ফোরজি সেবা মিলছে না। এ ক্ষেত্রে ফোরজিকে শক্তিশালী করে পরবর্তী সময়ে ফাইভজিতে যাওয়া ভালো।’
তিনি বলেন, ‘শুধু ঘোষণা দিলেই তো সেবা চালু করা যায় না। এজন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো প্রয়োজন। আর্থসামাজিক অবস্থার কথা বিবেচনা করতে হবে। এখনো দেশে প্রচুর কমদামি হ্যান্ডসেট বিক্রি হচ্ছে যেগুলো টুজি, থ্রিজি সাপোর্টেড। ফাইভজি সাপোর্টেড হ্যান্ডসেটের গ্রোথ যেভাবে বাড়ছে, সেটা খুবই নগণ্য। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।’
সাবির বলেন, ‘ভবিষ্যতে যদি আমরা অটোমেশনের দিকে যাই, বিশেষ করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অটোমেশনের কথা যদি চিন্তা করি তাহলে আমাদের ফাইভজির প্রয়োজনীয়তা আছে।’
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আইটি ইনচার্জ মাহমুদ খান বলেন, ‘দেশে ফোরজি নেটওয়ার্ক ভালো হলেও ইন্টারনেটের গতি অনেক কম। অপারেটর ভেদে গড়ে ২০-৪০ এমবিপিএস গতি পাওয়া যায়। অথচ ফোরজি নেটওয়ার্কে এ গতি অন্তত আড়াই থেকে তিনগুণ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।’
একাধিক মোবাইল অপারেটরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, বর্তমানে দেশে প্রায় ৫০ শতাংশ মোবাইল সিম ফোরজি সেবার বাইরে। তার মানে গ্রাহকদের ফোরজি ব্যবহারের একটা বড় জায়গা রয়েছে এখন পর্যন্ত। ফাইভজি সেবা চালু করতে যে অবকাঠামো দরকার তা এখনো তৈরি হয়নি দেশে। এখানে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের দরকার।
এ বিনিয়োগ করার আগে অপারেটররা রিটার্ন আশা করবে সেটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া ফাইভজির জন্য যে ধরনের মোবাইল হ্যান্ডসেট তা ১ শতাংশ পরিমাণও নেই। সব মিলে ফাইভজির জন্য উপযোগী পরিস্থিতি এখনো প্রস্তুত না হওয়ায় এটি চালু করা এখন উপযুক্ত সময় নয়।
তবে এটা একদিন না একদিন হবে সে আশা পোষণ করে ওই কর্মকর্তারা জানান, সেটার জন্য তাদের প্রস্তুতি আছে। এখন সবার জন্য ফোরজি সেবা নিশ্চিত করাই অপারেটরদের মূল অগ্রাধিকার। ফাইভজির অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ না করে যদি ফোরজি কিংবা বাকি নেটওয়ার্ক আধুনিকায়নে বিনিয়োগ করা হয় তাহলে গ্রাহকরা আরও উন্নত সেবা পাবে। বিনিয়োগ করা টাকা লাভসহ ফেরত পাওয়া যাবে। তবে এখন যে অবকাঠামো উন্নয়ন করা হচ্ছে, সেটা ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির কথা মাথায় নিয়েই করা হচ্ছে। এখান থেকে পরবর্তীকালে ফাইভজি সেবাও দেওয়া হবে।
প্রকাশক ও সম্পাদক
জাহিদুল ইসলাম
বার্তা সম্পাদক
সোহেলী চৌধুরী লিন্ডা
© 2024 সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || peoplenewsbd.com