দেশের অন্যতম ব্যবসায়ী গ্রুপ ট্রান্সকম লিমিটেডের অধিকাংশ শেয়ার জালিয়াতি করে দখল ও ভুয়া পারিবারিক সেটেলেমেন্ট দলিল তৈরির মামলায় গ্রুপটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিমিন রহমানসহ ছয় কর্মকর্তার জামিন বাতিল করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিভিশন পিটিশন দাখিল করা হয়েছে।
মামলা দুটির বাদী ট্রান্সকমের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের ছোট মেয়ে শাযরেহ্ হক পৃথক দুটি রিভিশন আবেদন ফাইল করেছেন। যেটির ওপর সোমবার (২৫ নভেম্বর) ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এই তথ্য রবিবার (২৪ নভেম্বর) গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন শাযরেহ্ হকের আইনজীবী আহসানুল করিম।
মামলার অন্য অসামীরা হলেন ট্রান্সকম গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স-আইন) মো. ফখরুজ্জামান ভূঁইয়া, পরিচালক (করপোরেট ফাইন্যান্স) কামরুল হাসান, পরিচালক (করপোরেট ফাইন্যান্স) আবদুল্লাহ আল মামুন, সহকারী কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ মোসাদ্দেক ও ব্যবস্থাপক (কোম্পানি সেক্রেটারি) আবু ইউসূফ মো. সিদ্দিক।
একটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) উপ-পরিদর্শক মেহেদী হাসান জানান, শাযরেহ্ হক ও আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের ভুয়া স্বাক্ষর দিয়ে শেয়ার ট্রান্সফারের যে ভুয়া দলির তৈরি করে আরজেএসসিতে দাখিল করার অভিযোগ সিমিন রহমানের বিরুদ্ধে, সেসব দলিলের মূল কপি পাওয়া যাচ্ছে না। এই মামলার তদন্তের স্বার্থে মূল দলিল প্রয়োজন। এ ছাড়া আসামীরা জামিনে থাকায় তাদের গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদও করা যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, এজন্য গত ২৯ মে আসামদের জামিন বাতিল করে পৃথক দুই মামলার একটিতে সাত দিন ও আরেকটিতে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে ঢাকার সিএমএম কোর্টের ২৭ নম্বর আদালতে পৃথক দুটি আবেদন করা হয়। কিন্তু সেই আবেদন খারিজ করেছেন আদালত।
শাযরেহ্ হকের আইনজীবীরা জানান, সিএমএম আদালতের ওই খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে পৃথক দুটি রিভিশন আবেদন ফাইল করে সিএমএম কোর্টের আদেশ বাতিল চাওয়া হয়েছে, এবং তদন্তের স্বার্থে আসামীদের জামিন বাতিল করে রিমান্ড চাওয়া হয়েছে।
মামলা সুত্রে জানা যায়, গত ফেব্রুয়ারিতে এই মামলাগুলো গুলশান থানায় দায়ের করে লতিফুর রহমানের ছোট মেয়ে শাযরেহ্ হক। এরপর এই মামলার কয়েক আসামীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরবর্তীতে তারা জামিন পান আর বিদেশ পলাতক থাকা সিমিন রহমান দেশে এসে আসার পর আদালত আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন।
ভুয়া দলিল সৃষ্টি করে ট্রান্সকমের অধিকাংশ শেয়ার দখলের মামলায় লতিফুর রহমানের ছোট মেয়ে শাযরেহ্ হক বলেছেন, ‘আমার পিতা মৃত লতিফুর রহমান তার জীবদ্দশায় ট্রান্সকম লিমিটেডের ২৩ হাজার ৬০০টি শেয়ারের মালিক থাকা অবস্থায় ২০২০ সালের ১ জুলাই মারা যান। আমিসহ অন্যান্য উত্তরাধিকারী আমার পিতার ওই শেয়ারের মুসলিম শরিয়া আইন অনুযায়ী মালিক। আমার পিতা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ থাকা অবস্থায় কুমিল্লায় মৃত্যুবরণ করেন। মারা যাওয়ার প্রায় এক বছর আগে থেকেই তিনি কুমিল্লাতে অবস্থান করছিলেন। আমার পিতার ২৩ হাজার ৬০০টি শেয়ার থেকে এক নম্বর আসামি (সিমিন রহমান) আমাকে এবং আমার ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে বঞ্চিত করার জন্য অবৈধভাবে নিজের নামে বেশি শেয়ার ট্রান্সফার করে হস্তগত করার হীন অসৎ উদ্দেশ্যে এক নম্বর আসামি দুই থেকে পাঁচ নম্বর আসামিদের (ট্রান্সকম কর্মকর্তা) প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তিনটি ফর্ম ১১৭ (হস্তান্তর দলিল)-সহ আরো গুরুত্বপূর্ণ শেয়ার ট্রান্সফারের বিভিন্ন কাগজপত্র আমার এবং আমার ভাইয়ের অজ্ঞাতসারে বিভিন্ন তারিখ ও সময়ে তৈরি করেন। আমার পিতার মৃত্যুর পর জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা কাগজপত্র তিন নম্বর আসামি (কামরুল হাসান) রেজিস্ট্রার অব জয়েন স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসে জমা দেন। এক নম্বর আসামি (সিমিন রহমান) থেকে অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে চার ও পাঁচ নম্বর আসামি (মোহাম্মদ মোসাদ্দেক ও আবু ইউসুফ মো. সিদ্দিক) জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করা কাগজে সাক্ষী হিসেবে সই করেন।’
শাযরেহ্ হক মামলার এজাহারে বলেছেন, আসামিরা পরস্পর ষড়যন্ত্র করে আমার, আমার পিতার এবং আমার ভাইয়ের সই জাল করে নিজেরাই ফর্ম ১১৭-তে সই করেন। শাযরেহ্ হক মামলায় বলেন, আমার পিতার মারা যাওয়ার পর প্রথমে দুই নম্বর আসামি (আইন উপদেষ্টা ফখরুজ্জামান ভূঁইয়া) গত বছরের ২৩ মার্চ এবং পরবর্তীকালে দুই ও তিন নম্বর আসামি (কামরুল হাসান) ১৪ মে আমাকে জানান, ‘আপনার পিতা আপনিসহ আপনার ভাইবোনদের শেয়ার হস্তান্তর করে দিয়েছেন।‘ পরে আমি জয়েন স্টক থেকে শেয়ার হস্তান্তরের নথিপত্র সংগ্রহ করি। অনলাইনের ওই দলিলাদি অনুযায়ী, ২০২০ সালের ১৩ জুন আমার পিতা আমাকে চার হাজার ২৭০টি শেয়ার, আমার ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে চার হাজার ২৭০টি শেয়ার এবং এক নম্বর আসামিকে (সিমিন রহমান) ১৪ হাজার ১৬০টি শেয়ার হস্তান্তর করেছেন মর্মে তিন নম্বর আসামি কামরুল শেয়ার হস্তান্তর সংক্রান্ত দলিল দাখিল করেছেন।
শাযরেহ্ হক মামলার এজাহারে আরো বলেন, কোনো সময়ই আমি কিংবা আমার ভাই ওই হস্তান্তর সংক্রান্ত ফর্ম-১১৭ দলিলে সই কিংবা টিপসই প্রদান করিনি। আমার পিতা তার জীবদ্দশায় কখনো হস্তান্তর সংক্রান্ত দলিলে সই কিংবা টিপসই করেননি। আসামিরা জাল-জালিয়াতি করে শরিয়া অনুযায়ী উত্তরাধিকারদের মধ্যে বণ্টন না করে আমাদের সই জাল করে শেয়ার হস্তগত করেছেন।
ভুয়া পারিবারিক সেটেলমন্টে দলিল তৈরির মামলায় শাযরেহ্ হক বলেছেন, আমিসহ অন্যান্য উত্তরাধিকারী আমার পিতার সব স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পত্তির মুসলিম শরিয়া আইন অনুযায়ী ওয়ারিশ। এক নম্বর আসামি (সিমিন রহমান) ও দুই নম্বর আসামি (শাহনাজ রহমান) আমার পিতার প্রতিষ্ঠিত ট্রান্সকম গ্রুপের শেয়ার এবং পজিশন নিজেদের অনুকূলে হস্তগত করার অসৎ উদ্দেশ্যে তিন ও পাঁচ নম্বর আসামির (ফখরুজ্জামান ভুইয়া ও যারাইফ আয়াত হোসেন) সহযোগিতায় জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ডিড অব সেটেলমেন্ট তৈরি করেন। যেখানে আমার, আমার পিতার এবং আমার ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের সই জাল করে আসামিরা নিজেরাই সই করেন। আসামিরা আমার দুই ছেলে যোহেব আসরার হক এবং মিকাইল ইমান হকের সই জাল করে নিজেরাই ডিড অব সেটেলমেন্টের সাক্ষীর কলামে সই করেন। আমাদের সঙ্গে আমাদের পিতা এবং এক নম্বর আসামি সিমিন রহমান ও দুই নম্বর আসামি শাহনাজ রহমানের সঙ্গে কখনো কোনোকালে ডিড অব সেটেলমেন্ট সম্পাদিত হয়নি। আমি, আমার পিতা, আমার ভাই ও আমার দুই ছেলে ডিড অব সেটেলমেন্টে কখনো কোনো সই করিনি।
শাযরেহ্ হক মামলায় অভিযোগ করেন, আসামিরা অসৎ ও অসাধু উপায় অবলম্বন করে আমাকে এবং আমার ভাইকে পিতার রেখে যাওয়া সম্পত্তি—যার মূল্য আনুমানিক ১০ হাজার কোটি টাকা বা তার বেশি, নিজেদের নামে কুক্ষিগত করার হীন উদ্দেশ্যে জাল ডিড অব সেটেলমেন্ট সম্পাদন করেন।
শাযরেহ্ হক বলেন, কথিত ডিড অব সেটেলমেন্টের অস্তিত্বের বিষয়ে আমি প্রথম জানতে পারি তিন ও চার নম্বর আসামির (ফখরুল ভূইয়া ও কামরুল হাসান) কাছে, যখন গত বছরের ১৪ মে তাদের কাছে আমার পিতার রেখে যাওয়া শেয়ার বণ্টনের জন্য উত্তরাধিকার সনদের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়েছে কিনা, তার খোঁজ নিই। তাদের কাছে কথিত ডিড অব সেটেলমেন্টের কপি সরবরাহ করতে বললে, তারা তা সরবরাহ করতে অস্বীকার করেন। ইতোমধ্যে আসামিরা কথিত ডিড অব সেটেলমেন্ট ব্যবহার করে আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন এবং এক সপ্তাহ পর প্রত্যাহার করে নেন। গত বছরের ১১ ডিসেম্বর আমি এই জাল দলিলের সন্ধান পাই।
শাযরেহ্ হকের অভিযোগ, তিন নম্বর আসামি (ফখরুল) তার অপকর্মের পুরস্কার হিসেবে ২০২১ সালে কোম্পানির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স-লিগ্যাল) হিসেবে প্রমোশন পান। চার নম্বর আসামি (কামরুল) তার অপকর্মের পুরস্কার হিসেবে ২০২৩ সালে কোম্পানির পরিচালক হিসেবে অবৈধভাবে নিয়োজিত হন এবং ১০০টি শেয়ার দুই নম্বর আসামির (শাহনাজ রহমান) কাছ থেকে অভিহিত মূল্যে খরিদ করেন, যা বেআইনি।
এই দুই মামলা ছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংক একিউন্টে প্রায় ১০০ টাকা লতিফুর রহমারে নামে ছিল, যা তার মৃত্যুর পর সিমিন রহমান ও লতিফুর রহমানারে স্ত্রী শাহনাজ রহমান আত্মসাত করার অভিযোগে একটি মামলা এবং ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে বিষ প্রয়োগ-শ্বাসরোধ করে হত্যার অভিযোগ এনে সিমিন রহমানের বিরুদ্ধে শাযরেহ্ হকের দায়ের করা মামলার চলমান।
পিপলনিউজ/আরইউ
প্রকাশক ও সম্পাদক
জাহিদুল ইসলাম
বার্তা সম্পাদক
সোহেলী চৌধুরী লিন্ডা
© 2024 সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || peoplenewsbd.com