ঢাকা, বাংলাদেশ ২০ অক্টোবর, ২০২৪

মৌলিক ও অমৌলিক মুদ্রাস্ফীতি

Publish : 05:55 AM, 09 September 2024.
মৌলিক ও অমৌলিক মুদ্রাস্ফীতি
নিরঞ্জন রায় :

আমরা যারা বাণিজ্য বা অর্থনীতি নিয়ে লেখাপড়া করেছি, তারা সবাই অর্থনীতিতে দুই ধরনের মুদ্রাস্ফীতি সম্পর্কে জেনেছি, যার একটি হচ্ছে চাহিদা প্রভাবিত (ডিমান্ড পুশ) মুদ্রাস্ফীতি এবং আরেকটি হচ্ছে উৎপাদন খরচ প্রভাবিত (কস্ট পুশ) মুদ্রাস্ফীতি। অনেক কারণে, বিশেষ করে কিছুটা সহজ মুদ্রানীতির কারণে অর্থনীতিতে অর্থের সরবরাহ বেড়ে যায়, কিন্তু উৎপাদন আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পায় না। ফলে বাজারে দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এই বর্ধিত চাহিদার কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, যা চাহিদা প্রভাবিত মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি করে।

পক্ষান্তরে দেশে পণ্য ও সেবার উৎপাদন বৃদ্ধি না পেলেও নানা কারণে উৎপাদন খরচ, বিশেষ করে দর-কষাকষির মাধ্যমে শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়। এই বর্ধিত উৎপাদন খরচের কারণে উৎপাদকরা উৎপাদিত পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়, যা মূলত উৎপাদন খরচ প্রভাবিত মুদ্রাস্ফীতির সৃষ্টি করে। অর্থনীতিবিদদের উদ্ভাবিত এই দুই ধরনের মুদ্রাস্ফীতির সূত্র অনুসরণ করেই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে শুধু মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এবং এতে বেশ ভালো ফলও পাওয়া গেছে।

মৌলিক ও অমৌলিক মুদ্রাস্ফীতিবিগত কয়েক দশকে বিশ্বব্যাপী আর্থিক খাতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। মুদ্রাব্যবস্থায় গতানুগতিক ধারার কার্যক্রমের পাশাপাশি অনেক হাইব্রিড প্রকৃতির লেনদেনে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। পণ্য বিপণনব্যবস্থা, বিশেষ করে সাপ্লাই চেইন পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে এখন মানুষের জীবনযাত্রার প্রণালী এবং অর্থ ব্যয়ের ধরনে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। এমন এক সময় ছিল যখন মানুষকে উপার্জন করে খরচ করতে হয়েছে।

এখন মানুষ আগে ধার করে বা ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে খরচ করে পরে উপার্জন করে তা পরিশোধ করে। এ কারণেই দেখা যায়, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং উচ্চ সুদের হারের সময়ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায় না।

অধিকন্তু বিশ্বব্যাপী বাজারব্যবস্থা, বিশেষ করে সাপ্লাই চেইন এবং খুচরা বিপণনব্যবস্থা চলে গেছে হাতে গোনা গুটিকয়েক বৃহত্তম করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে। এসব বৃহৎ করপোরেট প্রতিষ্ঠান এত বেশি অর্থবিত্তের মালিক যে তারা সরবরাহকারী এবং ভোক্তা উভয়ের ওপর পর্যাপ্ত প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ফলে এসব বৃহৎ কোম্পানি যে মূল্যে পণ্যসামগ্রী সংগ্রহ করতে চাইবে, সরবরাহকারী সেই মূল্যেই পণ্যসামগ্রী সরবরাহ করতে বাধ্য হবে।

আবার যে মূল্যে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করতে চাইবে, সেই মূল্যেই ভোক্তাদের ক্রয় করতে হবে। এই ব্যবস্থাকে আমাদের দেশে বলা হয় বাজার সিন্ডিকেট আর উন্নত বিশ্বে বলা হয় করপোরেট সংস্কৃতি। ফলাফল একই, অর্থাৎ জনগণকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য ভোগান্তির শিকার হতে হয়। এ রকম বিশৃঙ্খল বাজারব্যবস্থায় এখন আর গতানুগতিক মুদ্রাস্ফীতি সেভাবে কাজ করে না। ফলে এ রকম পরিবর্তিত বাজারব্যবস্থায় দ্রব্যমূল্যের গতি-প্রকৃতি এবং সাধারণ মানুষের ওপর এর প্রভাব তুলে ধরার জন্য নতুন সংজ্ঞার মুদ্রাস্ফীতি আলোচিত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত আলোচিত নতুন সংজ্ঞার মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে-(১) মৌলিক মুদ্রাস্ফীতি (কোর ইনফ্লেশন), (২) অমৌলিক মুদ্রাস্ফীতি (অ্যান্টি কোর ইনফ্লেশন) এবং (৩) সাধারণ মানুষের মুদ্রাস্ফীতি সূচক (কমন-ম্যান ইনফ্লেশন ইনডেক্স)।

মৌলিক মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে সেসব দ্রব্যমূল্য পরিবর্তনের হার, যেখানে খাদ্যদ্রব্য এবং জ্বালানি তেলের মূল্য অন্তর্ভুক্ত থাকে না। অর্থাৎ খাদ্যদ্রব্য এবং জ্বালানি তেল ব্যতীত অন্য পণ্যসামগ্রীর মূল্য পরিবর্তনের হার বিবেচনায় নিয়ে যে মুদ্রাস্ফীতি নির্ণয় করা হয় সেটিই মৌলিক মুদ্রাস্ফীতি হসেবে পরিচিত। এই মুদ্রাস্ফীতি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। যেমন-খাদ্যদ্রব্য এবং জ্বালানি তেল ব্যতীত অন্য সব পণ্য যে এই মুদ্রাস্ফীতি হিসাব করার ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেওয়া হবে তেমন কোনো কথা নেই। এই ধরনের মুদ্রাস্ফীতি নিরূপণের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের কোনো পণ্য বা সেবার মূল্য বাদ দেওয়ার একক ক্ষমতা থাকে, যাকে ডিসক্রিশনারি পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অমৌলিক মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে সেই ধরনের মুদ্রাস্ফীতি, যা নির্ণয় করা হয় খাদ্যদ্রব্য এবং জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পরিবর্তনের হারকে বিবেচনায় নিয়ে। মৌলিক মুদ্রাস্ফীতি নির্ণয়ের বাইরে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ভোক্তাদের অতি ব্যবহৃত জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে যে ইনফ্লেশন ইনডেক্স নিরূপণ করা হয়, সেটিই হচ্ছে অমৌলিক মুদ্রাস্ফীতি। এটি মূলত মৌলিক মুদ্রাস্ফীতির বিপরীত একটি অবস্থা।

সাধারণ মানুষের মুদ্রাস্ফীতি সূচক হচ্ছে আরেক ধরনের মুদ্রাস্ফীতি, যা মৌলিক ও অমৌলিক মুদ্রাস্ফীতির সংমিশ্রণে নির্ণয় করা হয়। এটি মূলত হাইব্রিড প্রকৃতির মুদ্রাস্ফীতি, যার আলোচনা অতি সম্প্রতি শুরু হয়েছে মাত্র। এই বিশেষ ধরনের মুদ্রাস্ফীতি সূচক নির্ণয়ের সময় এমন সব দ্রব্যসামগ্রী ও সেবার মূল্য অন্তর্ভুক্ত করা হয় যেগুলো মানুষ জীবনধারণের জন্য নিয়মিত ক্রয় করে থাকে। যেমন-খাদ্যদ্রব্য, জ্বালানি, বাসস্থান, বীমা, কাপড়চোপড়, ইউটিলিটি প্রভৃতি। মৌলিক মুদ্রাস্ফীতি হিসাব করার সময় খাদ্যদ্রব্য এবং জালানি তেলের মূল্য ব্যতীত অন্য পণ্যসামগ্রীর মূল্য বিবেচনায় নেওয়া হয়। পক্ষান্তরে অমৌলিক মুদ্রাস্ফীতি হিসাব করার সময় শুধু খাদ্যদ্রব্য এবং জ্বালানি তেলের মূল্য বিবেচনায় নেওয়া হয়। আর সাধারণ মানুষের মূল্যস্ফীতি সূচক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে খাদ্যদ্রব্য, জ্বালানি এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মূল্য বিবেচনায় নেওয়া হয়। আরো একটি বিষয় খুবই প্রাসঙ্গিক তা হচ্ছে, মৌলিক মুদ্রাস্ফীতি হিসাব করার সময় কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে কোন কোন পণ্যসামগ্রীর মূল্য মুদ্রাস্ফীতি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এই ডিসক্রিশনারি ব্যবস্থা অমৌলিক এবং সাধারণ মানুষের মুদ্রাস্ফীতি সূচক হিসাব করার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার সুযোগ নেই।

মৌলিক মুদ্রাস্ফীতিকেই মূলত অফিশিয়াল মুদ্রাস্ফীতি হিসেবে দেখা হয় এবং দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই মৌলিক মুদ্রাস্ফীতির বিষয়টি বিবেচনায় রেখে মুদ্রানীতি প্রণয়ন এবং প্রয়োগ করে থাকে। যখন মৌলিক মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায় তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের নীতি সুদহার বাড়িয়ে এই মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে। এই মুদ্রাস্ফীতি হিসাব করার সময় এমন পণ্য এবং সেবা অন্তর্ভুক্ত করা হয় না, যার ওপর মুদ্রানীতির কোনো রকম প্রভাব থাকে না। আর এ কারণেই মৌলিক মুদ্রাস্ফীতি কমে এলেও অমৌলিক মুদ্রাস্ফীতি বেশি থাকতে পারে। আবার সংবাদমাধ্যমে যে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে হেডলাইন করা হয় বা রাজনীতিবিদরা যে মুদ্রাস্ফীতির কথা উল্লেখ করে থাকেন, তা মূলত মৌলিক মুদ্রাস্ফীতি। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে যে অমৌলিক মুদ্রাস্ফীতি হেডলাইন মুদ্রাস্ফীতির চেয়ে অনেক ওপরে, যা প্রকৃতপক্ষে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার দুর্বিষহ অবস্থাকেই বোঝায়। যে অবস্থা এখন আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিরাজ করছে। ফলে তাদের হেডলাইন মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস পেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি চলে এলেও তারা তাদের নীতি সুদহার কমানোর সাহস দেখাচ্ছে না। কারণ তারা ভালো করেই জানে যে অমৌলিক মুদ্রাস্ফীতি এখনো অনেক বেশি।

বিভিন্ন আধুনিক সংজ্ঞার মুদ্রাস্ফীতি আমাদের দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনায় না থাকলেও এর প্রভাব যে আমাদের দেশের অর্থনীতিতে বেশ ভালোভাবেই আছে, তা বাজারে গেলে খুব সহজেই উপলব্ধি করা যায়। আর এ কারণেই আমাদের দেশে ঘোষিত মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। একই কারণে গতানুগতিক ধারার মুদ্রানীতি প্রয়োগ করে দাপ্তরিক মুদ্রাস্ফীতির লাগাম কিছুটা টেনে ধরা গেলেও বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কোনোভাবেই থামে না। আর ঘোষিত মুদ্রাস্ফীতির চেয়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ায়। বাস্তবতার কারণে মুদ্রাস্ফীতি এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয় নিয়ে পৃথকভাবে কিছুটা আলোচনা শুরু হলেও মৌলিক মুদ্রাস্ফীতি, অমৌলিক মুদ্রাস্ফীতি এবং সাধারণ মানুষের মুদ্রাস্ফীতির সূচক নিয়ে সেভাবে আলোচনা শুরু হয়নি। এখন মনে হয় সময় এসেছে মুদ্রাস্ফীতির এসব আধুনিক ধরন নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করা এবং সে অনুযায়ী মুদ্রানীতি প্রণয়ন এবং মুদ্রানীতিবহির্ভূত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে প্রকৃত দ্রব্যমূল্যের রাশ টেনে জনগণের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি নিয়ে আসা যায়।

লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা। 

পিপলনিউজ/আরইউ

মতামত বিভাগের অন্যান্য খবর

Follow Us

প্রকাশক ও সম্পাদক
জাহিদুল ইসলাম
বার্তা সম্পাদক
সোহেলী চৌধুরী লিন্ডা

© 2024 সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || peoplenewsbd.com

Develop by _ DigitalSolutions.Ltd
শিরোনাম পদত্যাগের ঘোষণা দিলেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান শিরোনাম খামেনির ওপর হামলা চালাতে পারে ইসরায়েল শিরোনাম পাকিস্তানের সঙ্গে ড্র করে সাফে টিকে রইল বাংলাদেশ শিরোনাম হাজারীবাগে ভবন নির্মাণে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি, গ্রেপ্তার ১ শিরোনাম ধর্ষণ মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামী বাবু গ্রেপ্তার শিরোনাম ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনে ডিএমপির ১২৬৩ মামলা, জরিমানা প্রায় ৫১ লাখ টাকা