স্বাধীনতা যেমন ছেলের হাতের মোয়া নয়; তেমনি দেশটি কারোর মামার বাড়িও না যে, যখন তখন যে যার মতো করে আবেদন আর আবদার নিয়ে রাজপথে নেমে গেলাম , শাহবাগ কিংবা সচিবালয় ঘেরাও করলাম অথবা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে দাবি জানালাম- আর এভাবে পুরো দেশকে অতীতের আয়নাঘর থেকে বায়নাঘরে পরিণত করলাম। এতো দাবি আর আবদার যখন ১৬ বছর ধরে হৃদয়ের গহীনে সুপ্ত রাখতে পেরেছেন তখন আর কটাদিন সবুর করতে পারাটাও অসম্ভব কিছু না। মানলাম অনেক বছর ধরে হাহাকার আর বঞ্চনার মধ্যে আমাদের বসবাস, তাই বলেতো এটি ভাবলে চলবে না যে, সবকিছু জাদুর মতো খুব অল্প সময়ের মধ্যে সমাধানে চলে আসবে আর আমরা প্রাপ্তিতে ভেসে যাবো। যে বা যাদের ইন্ধনে এই এইসব অযাচিত আন্দোলনের আয়োজন হয় তারা হয়তো ভুলে গেছে যে ছাত্রজনতার দায়িত্ব কিন্তু এখনো শেষ হয়ে যায়নি তারা কিন্তু এখনো দেশ সংস্কারের কাজে নিয়োজিত।
ভুলে গেলে চলবে না যে, ১৯৭১ সালে যেমন ৩০ লাখ শহীদ এবং দুই লাখেরও বেশি মা বোনদের সম্ভ্রমহানীর বিনিময়ে ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন আর ২৩ বছরের পাকিস্তানি দুঃশাসনের অবসান হয়ে বাংলাদেশ ভৌগোলিক, রাষ্ট্রীয় ও জনগণের স্বাধীনতা পেয়েছিলো। গত ৫ আগস্ট স্বৈরশাসক তথা ফ্যাসিবাদ সরকারের পতন করে ছাত্র আন্দোলন এবং এক মহান গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অনেক শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের মানুষ নতুন করে ভিন্ন স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এই স্বাধীনতা এই অর্জন অনেক মূল্যবান সম্পদ। তাই এর বিরুদ্ধে কেউ কিঞ্চিৎ আচরণ করলে ছাত্রসমাজ কাউকে ছাড় দিবে না। ইটস লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার।
দেশজুড়ে ময়লার ভাগাড়। তৃণমূল থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শ্রেণি পর্যন্ত তার বিপুল বিস্তৃতি। বিগত বছরগুলোতে কর্ততৃত্ববাদ এবং ফ্যাসিবাদের যে নগ্ন নৃত্য চলছিলো তখন এদেশের সুশীল সমাজ তাদের সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে নিজেদের ভঙ্গুর অস্তিত্ব রক্ষায় তৈলমর্দনের যে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন তাতে করে সমাজ এবং রাষ্ট্র বহুকাল ধরে বুদ্ধিজীবী নামক শব্দটা থেকে বঞ্চিত। পাহাড়সমান দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদকে ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করা, স্বজনপ্রীতি, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধি, হত্যা, গুম, অপসংস্কৃতি, বাকস্বাধীনতা হরণ, প্রশাসনিক অত্যাচার, অনিয়ম ইত্যাদি ইত্যাদির মধ্যে তেলাপোকার মতো বেঁচে থাকা মানুষগুলো হঠাৎ করে জেগে উঠে যখন মাত্র কয়েকদিন আগে ঘটে যাওয়া ছাত্র আন্দোলন থেকে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেওয়া আন্দোলনের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়ায় তখন বোধ করি তাদের জন্য ওই পরাজিত জীবনটাই উপযুক্ত ছিলো। কেননা স্বাধীনতা ভোগ করার চেয়ে এই প্রকৃতির মানুষগুলো কেবল তাচ্ছিল্য করেই সুখ পাচ্ছেন। আমরা যেন নিজেদের নিকৃষ্টতম করে পরিচিত না করি কারণ স্বৈরশাসকরা সাধারণদের নিকৃষ্টতম করে রাখতেই পছন্দ করতেন। কিছুদিন আগেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিমণির বিয়ে সংসার বাচ্চা, দিঘীর ওজন কমলো নাকি বাড়লো, জায়েদ খান কোথায় কয়টা ডিগবাজি দিলো, মামুন-লায়লার অশ্লীল কাহিনী, হিরো আলমের সস্তা বিনোদন, মিডিয়া জগতে কে কয় নাম্বার বিয়ে করলো, কোন সেলিব্রিটির বিয়েতে কয়টাকা খরচ কোন ডিজাইনারের কাপড় পরলো ইত্যাদি ইত্যাদি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নিউজ আর ভিডিওতে সয়লাব ছিলো। কষ্টের কথা হলো এই অপসংস্কৃতির বিষবাস্পে আমাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি উৎখাত হতে চলছিলো। গত বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চেহারাটাই যেন পাল্টে গেছে। মানুষের চাওয়া পাওয়া আর দৃষ্টি ভঙ্গিতে অনেকটা পরিবর্তন এসেছে। রুচিশীল সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি আমরা। এই আন্দোলন না হলে বোঝতেই পারতাম না আমরা দেশকে এতো ভালোবাসি। এই ভালোবাসা আর সম্প্রীতির বাংলাদেশ খুব সুন্দর। পৃথিবী অবাক হয়ে বাংলাদেশকে যেন নতুন করে চিনে নিচ্ছে। অল আইজ অন আওয়ার বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এখন সাহস জোগাচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশের ছাত্র আন্দোলনে। তারা এখন আইডল মানছে বাংলাদেশের ছাত্রদের। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং এর বিজয়ের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন আর দেশের তৃণমূল থেকে সংস্কারের কাজেও রয়েছে ছাত্রদের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। অনেকেই বলতে শুনি ছাত্ররা দেশ চালানোর জন্য অভিজ্ঞ নয়, এদের কী রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড আছে যে এরা দেশ চালানোর মতো উপদেষ্টা হওয়ার মতো যোগ্যতা রাখে। তাহলে বলতে হয় অতীতেও অনেকের ছিল না। উল্লেখিত পেশার প্রতি যথেষ্ট সম্মান রেখে বলছি গান-বাজনা, যাত্রা-পালা, নাটক, খেলার মাঠ থেকেও অনেকেই সরাসরি সংসদে গিয়েছেন এবং দায়িত্ব পালনে তারা শুধু অপরিপক্ব, আগ্রাসী মনোভাবেরই ছিলেন না তারা মহান সংসদের শ্রীহীনতাতেও পারদর্শী ছিলেন। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ আমাদের নিয়োগ দিয়েছেন, অনুমোদন করেছেন দেশবাসী তারা যেদিন বলবেন আমরা সেদিনই চলে যাবো। এরকম নির্লোভী সরকার আগে পেয়েছেন কখনো। তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে এখানে আসেননি। তারা এসেছেন গুছিয়ে দিতে সংস্কার করতে, তাদের সঠিক সময়টুকু দিন তারা ইনশাআল্লাহ ভালোকিছু দিবেন বলেই আমার বিশ্বাস। একই পরিবারের সদস্য হয়ে আমরা কেন সহযোগিতা করবো না। কিছুই করতে না পারি বসে বসে আশাতো করতে পারি। শাসকদের তিনটি গুণের কথা এরিস্টটলের ‘পলিটিক্স’-এ পাওয়া যায়, যেগুলো হলো- ১. প্রতিষ্ঠিত শাসনব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য, ২. সংশ্লিষ্ট দায়িত্বের যোগ্যতা এবং ৩. প্রচলিত সমাজের উত্তমতা এবং সততা (সূত্র : এরিস্টটল -এর পলিটিকস, সরদার ফজলুল করিম)।
আমরা আশাকরি এইসব গুণের সবগুলোই বর্তমান সরকার প্রধানের মধ্যে বিদ্যমান। তাই সুন্দর নির্ভেজাল, সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন না দেখে কিছু মানুষ যখন নিন্দা আর কুৎসা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন তাদের উদ্দেশ্যে বলতে ইচ্ছে করে, হাউ ডেসপিকেবল দে আর!
গত জুলাই মাস থেকে আগস্ট মাসের ৫ তারিখ পর্যন্ত এদেশের ছাত্ররা যে আন্দোলন শুরু করেছিলো কোটা সংস্কারের জন্য তা আর কোটা সংস্কারে লিপিবদ্ধ না থেকে পরবর্তীতে সকল শ্রেণির মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার আন্দোলন হয়ে যায় এবং গণআন্দোলন গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয়। আর শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদ সরকারের পতন ঘটে। তখন আমরা দেখেছি এদেশের আপামর জনসাধারণের মধ্যে কী পরিমাণ পুঞ্জিভূত ক্ষোভ এবং অসন্তুষ্টি। রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে কারখানা শ্রমিক, শিক্ষক, শিল্পী, আইনজীবী, প্রবাসী, ফুটপাত ব্যবসায়ী, হকার, বাচ্চা, বৃদ্ধ, শারীরিক প্রতিবন্ধী সবাই কেমন ঝাঁপিয়ে পরেছে। সবাই ছাত্রদের ভালোবেসে একতাবদ্ধ হয়ে রাজপথে নেমে এসেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলেছে স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে চরম প্রতিবাদ। ভালোবাসা সাহস আর বন্ধনের বাংলাদেশকে পৃথিবী দেখেছে অবাক হয়ে। সেই সময়ে যারা ছাত্রদের আন্দোলনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিয়েছেন তারাই আজ সামনে এসেছেন ছাত্রদের ভুলভ্রান্তি খুঁটে খুঁটে বের করতে। আর একদল আছেন বিভিন্ন আবেদন আবদার আর বায়নার লিস্ট সাজাতে। সেই লিস্ট নিয়ে একদফা, দুইদফা, চারদফার স্লোগান দিচ্ছেন রাজপথে। উন্নয়ন উন্নয়ন সয়লাবের অতীত বাংলাদেশে এখন শুধু কিছু মানুষের আন্দোলন আন্দোলনের সয়লাব। এতোদিন যারা বোবা ছিলেন তাদের মুখে এখন স্বাধীনতা অপব্যবহারের হুশিয়ারী বাক্য শুনতে ভীষণ বেমানান লাগে। এরা সবাই গৃহপালিত শত্রু।
আমাদের চারপাশে আমাদের নিজের দেশের শত্রুর অভাব নেই। এরা সুন্দর সময়টাতে কাঁদা ছড়ানোর ব্যাপারে সুনিপুণ এবং বদ্ধ পরিকর। এরা ভালোকিছু গ্রহণ করতে রুচিবোধ করেন না, এরা চিরকাল দেশের শত্রু। এদের আইডেন্টিফাই করা জরুরি এবং এদের জানান দেওয়া আবশ্যক যে, উই আর লুকিং ফর শত্রুজ।
লেখক : শিক্ষক ও কলাম লেখক।
পিপলনিউজ/আরইউ
আজকালের খবর/আরইউ
প্রকাশক ও সম্পাদক
জাহিদুল ইসলাম
বার্তা সম্পাদক
সোহেলী চৌধুরী লিন্ডা
© 2024 সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || peoplenewsbd.com