ধাবমান সময়ের সঙ্গী হয়ে মানুষ পথে হাঁটছে। জন্মের খানিক পরেই এ হাঁটা শুরু। তারপর বিরামহীন চলছে তো চলছেই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হাঁটা চলবেই। হাঁটার পথ ভিন্ন। কেউ হাঁটেন মরুভূমির বালুকা বেলায়। কেউ হাঁটেন বরফ কেটে। কেউ হাঁটেন পাহাড় ডিঙিয়ে। কেউ হাঁটেন প্রকৃতির সঙ্গী হয়ে। কেউ হাঁটেন নাগরিক জীবনে। হাঁটার ভিন্নতা আছেই। সঙ্গে আছে ভিন্ন ভিন্ন পথে কে কতটুকু হাঁটতে পারেন। নগর পরিব্রাজক মানুষ, পাহাড়ে হাঁপায়। বরফের পথ ডিঙানো মানুষ মরুভূমিতে অসহায়।
টুকটাক লেখালেখির কুঅভ্যাস থাকা এ অধমের উপলব্ধি-বুক চিতিয়ে লেখা এত সহজ নয়। এর জন্য নিজেকে তার উপযোগী করতে হয়। নিজের জীবনাচরণ এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। তাই তো রবির হাতে যা বেরোয়, কাজীর ক্ষেত্রে তেমনটি হয় না। জীবন বাবু যা লিখতে পারেন, অন্য বাবুরা তা পারেন না। এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘বল বীর বল উন্নত মম শির’-একজন দ্বারাই লিখা হয়। আবার প্রকৃতি ও বাংলার চিরন্তন সৌন্দর্য অপরূপ ব্যঞ্জনায় জীবন বাবুর কলমেই বেশি ফোটে। তাই একজনের কাজ অন্যজন করতে পারেন না। পারতে আসেনওনি।
নিজ অভিজ্ঞতায় দেখছি, নগরে থেকে অনেক কিছুই হওয়া যায়, কিন্তু এত সহজে ভালো মানুষ হওয়া যায় না। আর ভালো মানুষ না হলে ভালো লেখক হওয়াও সহজ নয়। কারণ নিজ জীবনাচরণ লেখায় অবশ্যই আসে। আর যদি লেখায় ভালো ভালো কথা নিয়ে আসা হয়, জীবনাচরণে না হয়ে, তবে লেখক নিজের কাছেই নিজে ভণ্ড থেকে যান।
এমন ভণ্ড অনেক দেখি, দেখছি। তাই আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানের বৃহৎ ও দুঃসাহসিক ভাবনা-নগরে জীবন কাটিয়ে বড় মাপের লেখক-সাহিত্যিক-কবি হওয়া সহজ নয়। হওয়া যেতে পারে; কিন্তু চিরস্থায়ী হওয়া যাবে না। কারণ পাঠক-বোদ্ধা লেখকের জীবনাচরণের সঙ্গে সৃষ্টি মেলাবেন। আর তখন স্পষ্ট হয়ে যাবে নিজের কাছেই তিনি ভণ্ড। তাই তার চূড়ান্ত গন্তব্য ভালো হওয়ার কথা না।
২৩ অক্টোবর বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমানের জন্মবার্ষিকী। ১৯২৯ সালের এদিনে তিনি পুরান ঢাকার মাহুতটুলিতে জন্মগ্রহণ করেন। কবি শামসুর রাহমানের বেড়ে ওঠা ঢাকা নগরেই। নাগরিক কষ্ট, সুখ-দুঃখ তার কবিতায় বিশেষভাবে উঠে এসেছে।
জীবনের সত্য-সুন্দরকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অনন্য। পাশাপাশি বাঙালির সব আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবদীপ্ত অধ্যায় ফিরে ফিরে এসেছে তার কবিতায়।
শামসুর রাহমান কবিতায় স্বাধীনতাকে বিশেষভাবে বিম্বিত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর মুক্তচিন্তার উচ্চকণ্ঠ কবি তিনি। তার কবিতার শরীরে রোমান্টিকতার সঙ্গে প্রতিবাদের মেলবন্ধন ঘটেছে, যা তার একান্ত নিজস্ব কাব্যবোধে জারিত। তিনি নিজে ছিলেন আত্মমগ্ন ও নিভৃতচারী। তার আত্মমগ্নতার ভেতরে শহুরে মধ্যবিত্ত জীবনাচরণ, প্রেম-ভালোবাসা, সাধারণ মানুষের জীবনসংগ্রাম-এক কথায় বাঙালির জীবনচিত্র উঠে এসেছে। সমকালীন বাংলা সাহিত্যে সর্বাধিক কবিতার রচয়িতা হিসেবে তিনি খ্যাতি পেয়েছেন। তিনি বাংলা কবিতার বরপুত্র।
১৯৪৮ সালে ‘উনিশ ঊনপঞ্চাশ’ শিরোনামে কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে সাহিত্যাঙ্গনে কবি শামসুর রাহমানের যাত্রা। যুবক বয়সেই তিনি জীবনানন্দীয় গভীর নিসর্গমগ্ন, প্রতীক-চিত্রকল্পের দ্যোতনাবাহী নিগূঢ় শিল্পবোধসম্পন্ন পরিচয় দেন। ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ শিরোনামের প্রথম কাব্যগ্রন্থে যে শামসুর রাহমানের আত্মপ্রকাশ, তিনি নন্দনপিয়াসী আত্মমগ্ন কবি; জীবনানন্দ আর সুধীন্দ্রনাথ দত্তেরই পরোক্ষ প্রতিধ্বনি।
সেই শিল্প আর আঙ্গিক প্রকরণলব্ধ শামসুর রাহমান কী বিস্ময়কর গণমুখী হয়ে উঠলেন ষাটের দশকের শেষভাগে সামরিক শাসনবিরোধী গণআন্দোলনে একাত্ম হয়ে! আত্মমগ্ন, লাজুক কবি অবলীলায় লিখলেন ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’, ‘আসাদের শার্ট’, ‘সফেদ পাঞ্জাবি’, ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’র মতো অসাধারণ সাড়া জাগানো গণমুখী কবিতা।
কবি শামসুর রাহমান আজীবন প্রগতির সংগ্রামে, মানবতার বাণীবাহক ও ধারক হিসেবে এ দেশের সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় এতটাই স্নাত হয়েছেন যে, তাকে ভুলে যাওয়া অসম্ভব। এমন দিনে নগরীর শ্যামলীর ছোট্ট দ্বিতল বাড়িতে কবি সিক্ত হবেন না ভক্তদের ভালোবাসায়।
বেঁচে থাকতে এ দিনটিতে ভক্ত-অনুরাগী ও পাঠকের ঢল নামতো। এবার হবে না এমন আনাগোনা। কিন্তু এর মাঝেও নিতান্ত নগণ্য কিছু মানুষ হেঁটে যাবেন এর আশপাশ। এটি তাদের মনের খেয়াল। রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ-পরবর্তী বাংলা কবিতায় জীবদ্দশাতেই বিপুলভাবে নন্দিত এ কবি দূর থেকে হয়তো তাদের দেখবেন। দেখবেন ও দেখছেন বর্তমান নাগরিক কবিদেরও!
কথা থাকে এমন জনপ্রিয়তা অর্জন তো কোনো সহজসাধ্য কাজ নয়। অন্তত আমৃত্যু নগরে থেকে। পুরোপুরি নাগরিক হয়ে। তিনি ক্ষণজন্মা না পারাদের একজন। তাই তো দল-মত-নির্বিশেষে সব গোষ্ঠী এ সময়ে তার জন্য হাহাকার করছে। কারও কারও হাহাকার লোক দেখানো। তা থাকবেই। আমৃত্যু মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িকতাসহ সব কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন কবি। কাঁপিয়েছেন রাজপথ। আক্রান্ত হয়েছেন জঙ্গিদের কুঠারাঘাতে। নগর ও নাগরিকদের নিয়ে উদ্বিগ্ন কবির শেষ কাব্যগ্রন্থের নাম ‘কবে শেষ হবে এ গ্রহণের কাল’। আজও চলছে এ গ্রহণের কাল। দুঃখের বিষয় প্রগতির ঝাণ্ডাধারী বলে গলা ফাটানোরাই গ্রহণের শিকার। গ্রহণ চলছে লেখক-সাহিত্যিক-কবিদের মধ্যে।
তাই তো নাগরিক হওয়া যায়, কিন্তু নাগরিক কবি হিসেবে ইতিহাসে স্থান নেওয়া সহজ নয়। কবি শামসুর রাহমান নিজেই ইতিহাস। তাই তো সম্ভব করেছেন অনেক কিছু। সফেদ রেশমি চুলের ভাঁজে দেখিয়েছেন নগরকে, দেখিয়েছেন কবিতাকে। হয়েছেন নাগরিক কবি। হয়েছেন বাংলা কবিতার ইতিহাস।
পিপলনিউজ/আরইউ
প্রকাশক ও সম্পাদক
জাহিদুল ইসলাম
বার্তা সম্পাদক
সোহেলী চৌধুরী লিন্ডা
© 2024 সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || peoplenewsbd.com