অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, অতি প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেওয়া হবে।
সচিবালয়ে মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা এ কথা বলেন।
‘অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন: আইন মন্ত্রণালয়ের কৈফিয়ত’ শীর্ষক এই সংবাদ সম্মেলনে আইন মন্ত্রণালয়ের বিগত ১০০ দিনের কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন আইন উপদেষ্টা। এ সময় ঢালাও মামলা, জিম্মি করে আন্দোলন, নিজের কাজের ক্ষেত্রে সন্তুষ্টি- এমন নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন তিনি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। এরপর গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেন।
সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের বিষয়ে সর্বত্রই একটি প্রশ্ন শোনা যায়, সেটি হলো তারা কত দিন থাকবে, তাদের মেয়াদ কত দিন হবে, নির্বাচন কবে হবে?’
এ বিষয়ে জবাব দিতে গিয়ে আসিফ নজরুল বলেন এটি আইন মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়। তবে আপনাকে একটি বিষয় বলি, আমরা মোস্ট এসেনশিয়াল কিছু সংস্কার করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেব। আমরা জাস্ট এই জিনিসটা চাই না যে আগের মতো কোনো ভুয়া নির্বাচন হোক। আর এটা চাই না-নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে কেউ আবার ভুয়া নির্বাচন করার সুযোগ পাক। এটি ছাড়া আর কোনো স্বার্থ নাই।
এ বিষয়ে আসিফ নজরুল আরো বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারে যারা আছেন, তাদের অধিকাংশই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের পেশায় ফিরে যাওয়ার জন্য আগ্রহী।
হয়রানিমূলক মামলা ঠেকাতে নতুন চিন্তা
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হতাহতের ঘটনায় হয়রানিমূলক মামলার প্রতিকারে নতুন চিন্তার কথা জানালেন আসিফ নজরুল। তিনি জানিয়েছেন, ডিসি, এসপি, জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে জেলা পর্যায়ে কোনো কমিটি করা যায় কিনা, সেই চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এই কমিটি মামলার প্রাথমিক তথ্যবিবরণী (এফআইআর) করার আগে যাচাই করে দেবে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হতাহতের ঘটনায় দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পূর্বশত্রুতা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা এবং চাঁদাবাজি ও হয়রানি করতেও অনেককে এসব মামলায় আসামি করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মামলায় ‘ইচ্ছামতো’ আসামি করা নিয়ে সমালোচনাও হচ্ছে।
আইন উপদেষ্টা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, হয়রানিমূলক মামলা নিয়ে আমরাও বিব্রত। এ নিয়ে নানা রকম প্রতিকার ব্যবস্থার কথা চিন্তা করা হয়েছে। একবার সিদ্ধান্ত হলো ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করে পুলিশকে একটি ক্ষমতা দেওয়া হোক যে তারা এফআইআর করার আগে একটি প্রাথমিক তদন্ত করবেন। তখন বিভিন্ন পক্ষ থেকে বলা হলো, এটি দেওয়া হলে পুলিশকে দ্বিগুণ স্বেচ্ছাচারিতা করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। তিনি বলেন, এখন যেটি চিন্তা করা হচ্ছে, সেটি হলো পুলিশ সুপার (এসপি), জেলা প্রশাসক (ডিসি), জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা- তাদের নিয়ে জেলা পর্যায়ে কোনো কমিটি করা যায় কিনা। এ ধরনের একটা রূপরেখা তৈরি করা যায় কিনা যে মামলার এফআইআর করার আগে এই কমিটি যাচাই করে দেবে।
এটি কেবল চিন্তা করা হচ্ছে বলে জানিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, এই নিয়ে দু-একজন আইনবিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছেন। বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে, তাদের কোনো প্রস্তাব থাকলে সেটি দিক।
আসিফ নজরুল বলেন, আজ যারা হয়রানিমূলক, মিথ্যা ও বাণিজ্যমূলক মামলা করছেন, কাউকে কাউকে নাকি হুমকিও দেওয়া হচ্ছে যে টাকা না দিলে মামলা করা হবে। তিনি বলেন, আপনারা (হয়রানিমূলক মামলাকারী) মনে রাখেন, আমি যদি এই মন্ত্রণালয়ে থাকি, আপনাদের কীভাবে শাস্তি দেওয়া যায়, সেটির আইন খুঁজে বের করব।
নিজেকে ১০-এর মধ্যে ৪ দিলেন
কাজের জন্য ১০-এর মধ্যে খুব বেশি হলে নিজেকে চার নম্বও দিলেন আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, আমার অভিজ্ঞতার হয়তো ঘাটতি আছে বা যোগ্যতারও হয়তো ঘাটতি আছে। কিন্তু বারবার একটি কথা বলি, সেটি হলো, আমার প্রচেষ্টার ঘাটতি নেই।
সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, এত দিনে (সরকারের ১০০ দিন) কোন কাজটি করতে পারেননি বলে মনে করেন? জবাবে আসিফ নজরুল হাসতে হাসতে বলেন, ‘যা যা করেছি, তার বাইরে কিছুই করতে পারিনি।’
আরেক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ‘আপনার কোনো অতৃপ্তির জায়গা আছে কিনা?’ জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, আমার অতৃপ্তির অনেক জায়গা আছে।
এ সময় আমলাতান্ত্রিক জটিলতার একটি ছোট উদাহরণ টেনে আসিফ নজরুল বলেন, আমার দপ্তরে একবার দুই উপদেষ্টা আসেন। আমি তাদের বলি, পূর্ণিমা দোকানের (গুলিস্তান এলাকায় অবস্থিত) জিলাপি ও শিঙাড়া খুব মজার। সেগুলো খাবেন কিনা। তারা বললেন, খাবেন। এরপর তা আনতে দিলাম। সেগুলো আনতে এক ঘণ্টা পাঁচ মিনিট সময় লাগল। আসলে সময় লাগার কথা ১৫ মিনিট। তখন আমি খতিয়ে দেখলেন, কেন এত সময় লাগল।
উপদেষ্টা বলেন, ‘দেখা গেল, আমি ওনাকে বলেছি, উনি ওনাকে বলেছেন। পঞ্চম ব্যক্তি যখন আনতে গেছেন, তখন উনি জানেনও না যে এটি জরুরি বা আইন উপদেষ্টা এটি চাচ্ছেন। উনি ওনার ইচ্ছেমতো এনেছেন। এটি একটি উদাহরণ নয়। এটি হচ্ছে, কীভাবে আমাদের প্রশাসন চলছে।’
নিজের কর্মমূল্যায়ন নিয়ে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমি কোনো দিনও সন্তুষ্ট নই আমার কাজে। আমি একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ। যখন রাতে একা থাকি, তখন সব সময় দোয়া করি আল্লাহর কাছে, আমাকে যে সুযোগ দিয়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, আমি যেন সততা নিয়ে আরো কাজ করতে পারি। আমি বলি, আল্লাহ আমার জন্য কাজটা সহজ করে দাও। আরো যেন কাজ করতে পারি।’
জিম্মি করা আন্দোলনের বিপক্ষে জনগণ শক্তিশালী হচ্ছে
আসিফ নজরুল বলেছেন, আমি শুনেছি, ট্রেনের মধ্যে ইট মেরে নারী-শিশুদের আহত করা হয়েছে। এটি কী ধরনের আন্দোলন! আর আপনি রাতারাতি একটা কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় বানায়ে দিতে বলবেন, এইচএসসি পরীক্ষা দেবো না, রেজাল্ট বদলায়ে দিতে হবে। এখন আবার একটু কঠোর পদক্ষেপ নিলেও সবাই সমালোচনা করা শুরু করে। এখন এটির মধ্যে ব্যালেন্স করা একটু টাফ। তিনি বলেন, তবে ব্যক্তিগত ধারণা, সাধারণ জনমত এ ধরনের হয়রানিমূলক, জিম্মি করা আন্দোলনের বিপক্ষে অত্যন্ত শক্তিশালী হচ্ছে।
আসিফ নজরুল বলেন, যে কেউ ভিন্নমত পোষণ করতে পারেন। কিন্তু এভাবে রাস্তা ব্লক করে দেওয়া, সাধারণ মানুষকে ভোগান্তির মধ্যে ফেলা, সাধারণ মানুষকে জিম্মি করা, অসহনীয় ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি করা, আন্দোলনকারীরা যদি এ ধরনের কাজ অব্যাহত রাখে, আমি মনে করি-সাধারণ মানুষের উচিত তাদের পক্ষ থেকে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। আপনি আন্দোলন করবেন, আন্দোলনের তো একটা নর্মস থাকা দরকার। কিছুটা নর্মস তো থাকা দরকার, সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে দিতে পারেন না।
পিপলনিউজ/আরইউ
প্রকাশক ও সম্পাদক
জাহিদুল ইসলাম
বার্তা সম্পাদক
সোহেলী চৌধুরী লিন্ডা
© 2024 সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || peoplenewsbd.com