ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের অবরোধের কারণে বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) ঢাকার বিভিন্ন ব্যস্ততম সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। মহাখালী, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, গাবতলী, ডেমরা ও রামপুরাসহ আরো বিভিন্ন এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা একযোগে সড়ক অবরোধ করেন। ফলে ওইসব এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রী ও পথচারীরা।
এদিকে মহাখালীতে রেল লাইনে অবস্থান নেন রিকশাচালকরা। এতে ঢাকার সঙ্গে সব জেলার রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এতে কমলাপুর ষ্টেশনে শতশত যাত্রীরা ভোগান্তীতে পড়েন। পরে প্রায় ছয় ঘণ্টা পর ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়।
এদিকে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রিকশাচালকরা জড়ো হতে থাকেন। পুলিশ তাদের সরে যেতে বললেও তারা সড়ক ছেড়ে যাননি।
এ প্রসঙ্গে ট্রাফিক-গুনশান বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) জিয়াউর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, মহাখালী মোড়ে সকাল সাড়ে ৯টার পর ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা সড়ক অবরোধ করেন। প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার চালক একসঙ্গে জড়ো হন। তবে তারা কেউ রিকশা নিয়ে আসেননি। পায়ে হেঁটে এসে হঠাৎ অবরোধ শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের বুঝিয়ে সড়ক অবরোধ ছেড়ে দিতে বলা হলেও তারা সরেননি। এতে মহাখালী, তেজগাঁও, বনানী, গুলশান ও আশপাশের সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।’
এদিকে ট্রাফিক-মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) ইয়াসিনা ফেরদৌস গণমাধ্যমকে বলেন, সকালে মিরপুরের মাজার রোড, দারুসসালাম, কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়া এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা সড়ক অবরোধ করেন।
অপরদিকে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান জানান, সকাল ১০টার দিকে মোহাম্মদপুরের তিন রাস্তা মোড়ে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা সড়ক অবরোধ করেন। এতে করে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। ভোগান্তিতে পড়েন শত শত মানুষ। তিন রাস্তা এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়।
কিছু বললে পুড়িয়ে ফেলবো : সকাল থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকদের অবরোধের কারণে কোনো যানবাহন না পেয়ে নারী, শিশুসহ অনেকেই দীর্ঘ পথ হেঁটে গন্তব্যে যেতে দেখা যায়।
বছিলা থেকে অসুস্থ শিশুকে নিয়ে শ্যামলী শিশু হাসপাতালে যাবেন মমিন শেখ। কোনো উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে চার বছরের শিশুসন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করেন। বাসা থেকে সিএনজি অটোরিকশায় উঠলেও পথে বাধা দিয়ে সিএনজি অটোরিকশা থামিয়ে তাদের নামিয়ে দেওয়া হয়।
মমিন শেখ সাংবাদিকদের বলেন, বাচ্চা অসুস্থ, স্ত্রী হাঁটতে পারে না। অথচ কথায় কথায় আন্দোলন ডেকে পথঘাট আটকে রাখে! যারা আন্দোলন করছে কথায় কথায়, সরকারের উচিত এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মোহাম্মদপুর এলাকায় পুরো সড়ক বন্ধ করে রাখা হয়। সবাই হেঁটে গন্তব্যস্থলে যান।
মতিঝিল এলাকার আব্দুল্লাহ আল মামুন কাজ করেন একটি কুরিয়ার সার্ভিসে। অফিসে যাওয়ার সময় আন্দোলনকারীরা তার গাড়ি ভেঙে দিয়েছেন। আক্ষেপ করে মামুন বলেন, আমি আসছিলাম, পথে হুট করে আমার গাড়িটা ভেঙে দিলো। মতিঝিল থেকে বছিলায় আসছি, এখন কাজে যাবো অথচ আমাকে যেতে দেওয়া হয়নি। গাড়ি ভেঙে বলে কিছু বললে গাড়ি পুড়িয়ে ফেলবো।
অবরোধের এক পর্যায়ে দুপুরের দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ি ও আশপাশের কয়েক জায়গায় ভাঙচুর করা হয়।
তবে নিজেদের আক্ষেপের কথা জানিয়ে এক আন্দোলনকারী বলেন, আগে ব্যাটারিচালিত গাড়ি আমদানি বন্ধ করেন, তারপর আমাদের গাড়ি বন্ধ করেন। আমরা কিস্তিতে ব্যাটারিচালিত গাড়ি (অটোরিকশা) কিনেছি, এখন কিস্তি শোধ করবো কীভাবে?
মহাখালী এলাকায় দীর্ঘক্ষণ আটকে ছিলেন রেজা মাহমুদ নামের এক মোটরসাইকেল চালক। যাবেন উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরে। মাহমুদ বলেন, আর পারি না ভাই, কথায় কথায় সড়ক অবরোধ। এক জায়গায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রয়েছি। এখন আমাদের পথে নামতে হবে কেউ যেন আন্দোলনের নামে সড়ক অবরোধ না করতে পারে।
মহাখালী মোড় অবরোধ করে সকাল থেকে অবস্থান নিয়ে রেলসহ সব ধরনের যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রাখেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। তাদের অনড় অবস্থানে স্থবির হয়ে পড়ে মহাখালীসহ আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকা। সব যানবাহন দীর্ঘ-লাইনে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকেন দীর্ঘক্ষণ। তাতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে উঠে।
সকাল ১০টা থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের রেললাইন অবরোধের কারণে কোনো ট্রেন কমলাপুর থেকে ছেড়ে যায়নি। ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা।
সর্বশেষ দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা পর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বাধার মুখে রাস্তা থেকে সরে যান আন্দোলনরত চালকরা। তারা রাস্তা থেকে সরে গেলে একদিকে যেমন মহাখালী রেল লাইনের অবরোধ শেষ হয় তেমনি রাস্তার অবরোধ শেষ হয়। পরে বিকাল তিনটা থেকে মহাখালীর সব রাস্তায় যান চলাচল শুরু হয়। তবে দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা সড়ক অবরোধের ফলে যানজট চারদিকে ছড়িয়ে যায়।
এর আগে বেলা ১১টার দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবরোধ তুলে নিতে বললে রিকশাচালকরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেন। একপর্যায়ে উভয়ের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়। পরে রিকশাচালকরা রেললাইনের পাথর দিয়ে মহাখালী এসকেএস শপিং মল, রাওয়া ক্লাব ও সিটি ব্যাংকের একটি এটিএম বুথ ভাঙচুর করেন।
অপরদিকে রামপুরায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করা ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের সরিয়ে দিয়েছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। ফলে রামপুরা-মালিবাগ ও রামপুরা-বাড্ডা সড়কের দুই পাশ দিয়েই যানচলাচল শুরু হয়। দুপুর ১টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছালে রিকশাচালকরা সড়ক ছেড়ে পালিয়ে যান।
এসময় স্থানীয় মানুষ, দোকানি, পথচারীরা, সিএনজি, বাসের চালক ও হেলপাররাও সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে রিকশাচালকদের ধাওয়া করেন। এতে সড়ক থেকে পালিয়ে বিভিন্ন অলিগলিতে ঢুকে পড়েন আন্দোলনরত রিকশাচালকরা।
স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগপন্থি কিছু রিকশা গ্যারেজের মালিক অসহায় চালকদের রাস্তায় নামিয়ে ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টা করছেন। সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ঢাকা মহানগরের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত সঠিক বলেও মনে করেন তারা।
এর আগে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা মহানগরী এলাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধের প্রতিবাদে রামপুরা বাজার এলাকায় রামপুরা-মালিবাগ এবং রামপুরা-বাড্ডা সড়ক অবরোধ করেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা। এতে কুড়িল থেকে পুরো প্রগতি সরণিজুড়ে ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। ভোগান্তিতে পড়েন কর্মজীবী, ছাত্র-ছাত্রীসহ যাতায়াত করা মানুষ।
বিগত সময়ে দেখা গেছে, রাজধানীর মূল সড়কের চেয়ে অলিগলিতে ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল বেশি। সুযোগ পেলে মূল সড়কও দাপিয়ে বেড়ায় এসব রিকশা। খিলগাঁও, মান্ডা, বাসাবো, মানিকনগর, রামপুরা, বাড্ডা, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, সবুজবাগ, শ্যামপুর, ডেমরা, মোহাম্মদপুর, বছিলা, উত্তরা, ভাটারা, দক্ষিণখান, উত্তরখান, ময়নারটেক, মিরপুর, পল্লবী এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশার সংখ্যা বেশি।
এসব এলাকা ছাড়াও রাজধানীর প্রায় সর্বত্র ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল রয়েছে। ফলে নিয়মিত ঘটছে দুর্ঘটনা। অনেকে আহত হচ্ছেন, প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কয়েক দফা অভিযান চালালেও থেমে নেই অবৈধ এসব বাহনের দৌরাত্ম্য।
এর আগে মঙ্গলবার ঢাকা মহানগর এলাকায় তিনদিনের মধ্যে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এ সংক্রান্ত বিষয়ে দায়ের করা রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি মাহমুদুর রাজীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। একই সঙ্গে এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নেওয়া কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত। স্বরাষ্ট্র সচিব, স্থানীয় সরকার সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের আদালতের এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। এই আদেশের পর বুধবার (২০ নভেম্বর) রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জ, মিরপুর, কল্যাণপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করেন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালকরা।
সম্প্রতি এক পরিসংখ্যান প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানা গেছে, বর্তমান সময়ে রাজধানীতে প্রায় ১৩ লাখ রিকশা চলাচল করছে। এর একটি বড় অংশ হচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা।
এ ছাড়া পুরাতন প্যাডেলচালিত অনেক রিকশাতেও ব্যাটারি লাগিয়ে তা যান্ত্রিক যানে পরিণত করা হচ্ছে।
রাজধানীর প্রায় সর্বত্র অপেশাদার চালকের দ্বারা ব্যাটারিচালিত রিকশার অবাধ চলাচলের কারণে নিয়মিত দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। অনেকে আহত হচ্ছেন, প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে।
পিপলনিউজ/আরইউ
প্রকাশক ও সম্পাদক
জাহিদুল ইসলাম
বার্তা সম্পাদক
সোহেলী চৌধুরী লিন্ডা
© 2024 সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || peoplenewsbd.com