ঢাকা, বাংলাদেশ ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

পোশাক খাতে শ্রমিক আন্দোলন ঠেকাতে কঠোর সরকার

Publish : 03:14 PM, 03 October 2024.
পোশাক খাতে শ্রমিক আন্দোলন ঠেকাতে কঠোর সরকার
সংগৃহীত
নিজস্ব প্রতিবেদক :

গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর নতুন করে অস্থির হয়ে ওঠে পোশাক খাত। মজুরি, হাজিরা বোনাস, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, নিয়োগসহ বিভিন্ন দাবিতে কয়েক দিন ধরেই পোশাক শিল্পে চলছে চরম অসন্তোষ। শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে ইতোমধ্যে গাজীপুর, সাভার ও আশুলিয়ায় শতাধিক পোশাক কারাখানায় ছুটি ঘোষণা করেছে মালিকপক্ষ। উল্লিখিত স্থানগুলোয় আন্দোলন করছেন শ্রমিকরা। এর মাঝে অনেক বহিরাগত ঢুকে পরিবেশ অস্থির করার অপচেষ্টায় লিপ্ত বলে খোদ অন্তর্বর্তকালীন সরকারের উপদেষ্টারা অভিযোগ করেন। 

শ্রমিক বিক্ষোভে একের পর এক শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, নিরাপত্তা চেয়ে ব্যবসায়ীদের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতের পর বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) সচিবালয়ে বৈঠক করেছেন পাঁচ উপদেষ্টা।

বৈঠক শেষে বলা হয়েছে, এই অসন্তোষের কোনো গতি প্রকৃতি বোঝা যাচ্ছে না। ভাঙচুরের পেছনে ভাড়াটে ও টোকাইদেরও দায়ী করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বল প্রয়োগের বার্তাও দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ শ্রমিক আন্দোলন ঠেকাতে কঠোর ভূমিকায় যাবে সরকার। 

এর মাঝে বুধবারও গাজীপুর ও সাভারে শ্রমিক বিক্ষোভ হয়েছে। এতে পরিস্থিতি অবনতির শঙ্কায় ছুটি দেওয়া হয়েছে ৬০টি কারখানায়। অবশ্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে আজ বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) থেকে সব কারখানা খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন মালিকরা। বুধবার বিকালে চলমান শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এই কথা জানান বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম।

এর আগে পোশাক খাতে বিরাজমান শ্রম পরিস্থিতি বিষয়ে রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ কমপ্লেক্সে জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বিজিএমইএ নেতারা ছাড়াও এনএসআই, শিল্প পুলিশ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

অন্যদিকে বুধবার সচিবালয়ে বৈঠকে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, পোশাক শিল্পে ঝুট ব্যবসায় এখনো আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীরা রয়ে গেছেন এবং বিএনপির লোকেরাও এখানে দখল করতে আসছেন। তিনি বিএনপিকে তাদের দলের লোকদের নিবৃত্ত করার অনুরোধ জানিয়ে আওয়ামী লীগের লোকদেরকে কঠোর হাতে দমন করার বার্তা দিয়েছেন।

বুধবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও আসিফ মাহমুদ ছাড়াও অংশ নেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ; আইন, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং সংস্কৃতি উপদেষ্টা আসিফ নজরুল; মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার; শিল্প মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান।

গত কয়েকদিন গাজীপুর, সাভার ও আশুলিয়ায় একের পর এক শ্রমিক বিক্ষোভের মধ্যে গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেন ব্যবসায়ীদের ছয় জন নেতা। তারা শিল্প কারখানায় নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানান। তারা বলেন, কারখানায় নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।

শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, শ্রমিক নেতারা সব সময় শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু এখন যে আন্দোলন হচ্ছে সেটির গতিপ্রকৃতি বোঝা যাচ্ছে না। এখানে কোনো নির্দিষ্ট দাবি উঠে আসছে না, কোনো নির্দিষ্ট দফা পাওয়া যাচ্ছে না। আন্দোলনে বহিরাগতদের দেখা যাচ্ছে।

তিনি বলেন, কয়েকটি ছোট ছোট জায়গায় অসন্তোষকে কেন্দ্র করে বহিরাগত এবং নানা সংগঠনের নামে যারা কখনো শ্রম এলাকার মধ্যে আন্দোলন করেনি, তারা এসে গাড়ি ভাঙচুরের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। শ্রমিক নেতারাই আমাকে বললেন, তারা সেখানে হেঁটে এসেছেন এবং তারা দেখেছেন যে, হেলমেট ও হাফপ্যান্ট পরা যারা, টোকাই, যাদের টাকা দিয়ে বিভিন্ন প্রোগ্রামের জন্য ভাড়া করা হয়, তাদেরকে সেখানে দেখা গেছে।

শ্রমিকদের মধ্যে বহিরাগতদের দেখা যাওয়ার কথা তুলে ধরে উপদেষ্টা আসিফ বলেন, যারা সাধারণত শ্রমিক আন্দোলনগুলো সংগঠিত করেন, তারাও সেখানে সেভাবে নেই। কিছু কিছু জায়গায় মালিকপক্ষ বেতন দিতে দেরি করছে, এ জন্য আন্দোলন হচ্ছে। কয়েকটি স্পেসিফিক ফ্যাক্টরি আছে সেখানে মালিকপক্ষ পালিয়ে গেছে, সেখানে কিছুটা অসন্তোষ হয়েছে। সেগুলো আমরা অ্যাড্রেস করছি, সেগুলোর জন্য সরকার সফট লোন ঘোষণা দিয়েছে। সেটির পরিধি আরো বৃদ্ধি করা হবে।

শ্রমিকদের দাবি নিয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে বলেও মত দেন উপদেষ্টা আসিফ। তিনি বলেন, একদিন বসে শ্রম আইন ঠিক করা যাবে না। পোশাক খাতে ঝুট ব্যবসা নিয়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের লোকেরা যে সিন্ডিকেটগুলো সামলাত, তারা সেগুলো ছেড়ে চলে গেছে। এখন যারা সেগুলো দখলের পাঁয়তারা করছে এবং সেখানে সন্ত্রাস করছে, তাদের এবং যারা বহিরাগত আছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে। 

কারা দখলের পাঁয়তারা করছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগও আছে কিছু জায়গায়, কিছু স্থানীয় বিএনপির নেতারাও রয়েছেন বলে আমরা সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আমাদের এ বিষয়ে কথা হচ্ছে, তারা যাতে তাদের নিবৃত্ত রাখেন। স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী যেসব আওয়ামী লীগ নেতা এখনো রয়ে গেছেন, তাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে যাব। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেই তথ্যের ভিত্তিতে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।

শ্রমিক বাঁচাতে, অর্থনীতি বাঁচাতে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া মন্তব্য করে শ্রম উপদেষ্টা বলেন, বহিরাগতদের এ ভাঙচুরের কারণে দেশের ৫০ লাখ শ্রমিকের কষ্ট হচ্ছে, এদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেব। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বুধবার থেকে পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী অভিযানে যাবে।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, পুলিশ যে মনোবল হারিয়েছে সেটি ফেরাতে হবে। তাদেরকে কাজের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ব্যাপারে আমরা কাজ করছি।

এদিকে উপদেষ্টা হাসান আরিফ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে বল প্রয়োগের হুঁশিয়ারি দেন। শ্রমিকদের সঙ্গে বহিরাগতরা এমনভাবে মিশে আছে, যে তাদের আলাদা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে মন্তব্য করে উপদেষ্টা বলেন, কারখানা, শ্রমিক ও দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে গেলে কিছু সংখ্যকের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, তারা গ্রেপ্তার কিংবা আটক হতে পারেন। ৫০ জন রাস্তায় বসে পড়লে পাঁচ লাখ মানুষের অসুবিধা হবে। কাজেই তাদের সরাতে যদি বলপ্রয়োগ করতে হয়, লাঠিপেটা করতে হয়, জলকামান ব্যবহার করতে হলে আমরা সেটি করব। হাসান আরিফ বলেন, প্রকৃত শ্রমিক যারা, তারা কেউ নিজের বাড়ি পোড়াবে না, কারণ এখানে তার জীবিকা। এটা বহিরাগতরা এসে করেছে। বহিরাগতদেরকে বাধা দিতে শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আপনারা তাদের বাধা দিলে আমরাও আপনাদের সঙ্গে থাকব। পুরো ঘটনা নিয়ে চক্রান্তের অভিযোগ এনে উপদেষ্টা বলেন, আপনারা খেয়াল করে থাকবেন, যেগুলো ভাইব্রেন্ট কারখানা... কুমিল্লায় প্রাণ কোম্পানির কারখানা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, প্রাণ কোম্পানিতে কোনোদিন শ্রমিক বিশৃঙ্খলা ছিল না। এই কোম্পানি যেহেতু দিনকে দিন বিশ্ব ছেয়ে ফেলছে, এটা যদি নষ্ট হয়, তাহলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার অর্জন বন্ধ হয়ে যাবে।

এদিকে বুধবার সচিবালয়ে উপদেষ্টাদের বৈঠক চলার সময়েই সাভারের আশুলিয়ায় অন্তত ৬০টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। সকাল ১০টার দিকে বাইপাইল-আব্দুল্লাহপুর সড়কের বাইপাইল থেকে জিরাবো পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশের এসব কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়। শিল্প পুলিশ জানায়, বুধবার সকালে যথানিয়মে কারখানায় যান শ্রমিকরা। কিন্তু কাজ না করে বিভিন্ন দাবি আদায়ে বিক্ষোভ শুরু করলে কর্তৃপক্ষ একের পর এক কারখানা ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। পরে শ্রমিকরা বেরিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখা কারখানাগুলোর সামনে গিয়ে বিক্ষোভ ও ইট পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করলে সেসব কারখানায়ও ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ার ছোট বড় অন্তত ৬০টি পোশাক কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

সকাল ১০টার দিকে আব্দুল্লাহপুর-বাইপাইল সড়কের বাইপাইল থেকে জিরাবো পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হলেও বিক্ষিপ্ত অবস্থায় বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেন শ্রমিকরা। এতে করে সড়কটিতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করেন শিল্প পুলিশ, সেনাবাহিনী ও বিজিবি সদস্যরা।

শিল্প পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলম বলেন, শ্রমিকদের বিক্ষোভের মুখে বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কের জিরাবো এলাকা পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশে হামীম, শারমীনসহ অন্তত ৬০টি কারখানা কর্তৃপক্ষ কারখানা ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। 

এদিকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেয়ে কারখানা খোলার বিষয়ে বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় বৃহস্পতিবার থেকে সাভার, আশুলিয়াসহ অন্যান্য এলাকায় পোশাক কারখানা খোলা হবে। বুধবার নিরাপত্তা শঙ্কায় ১৬৭টি কারখানা বন্ধ ছিল।

পিপলনিউজ/আরইউ

অর্থনীতি বিভাগের অন্যান্য খবর

Follow Us

প্রকাশক ও সম্পাদক
জাহিদুল ইসলাম
বার্তা সম্পাদক
সোহেলী চৌধুরী লিন্ডা

© 2024 সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || peoplenewsbd.com

Develop by _ DigitalSolutions.Ltd
শিরোনাম বিক্ষোভে উত্তাল পাকিস্তান, ইসলামাবাদে ডি-চক রণক্ষেত্র শিরোনাম সংবিধান সংস্কার কমিশনে বিএনপির লিখিত ৬২ প্রস্তাব শিরোনাম চট্টগ্রামে সংঘর্ষে আইনজীবী নিহত শিরোনাম চিন্ময় দাসকে কারাগারে পাঠানো নিয়ে যা বলল ভারত শিরোনাম কুমিল্লায় ট্রেনের ধাক্কায় অটোরিকশার চালকসহ নিহত ৭ শিরোনাম চিন্ময় কৃষ্ণ দাস কারাগারে